প্রকাশিত:
২ অক্টোবর, ২০২৫
ধানগাছের কচি শিষে সেই আলোর ঝিলিক, প্রভাতবেলা শিউলির পসরা-সকল মিলিয়া বাংলার প্রকৃতি যেন নিজেই উৎসবমুখর হইয়া উঠে। প্রকৃতির বুক জুড়িয়া যেন এক স্বতঃস্ফূর্ত আবেশ ছড়াইয়া পড়ে। ঋতু চক্রের এই অনন্য সৌন্দর্য কেবল চর্মচক্ষুর আনন্দ নহে; ইহা সনাতন বাঙালির অন্তরেও বাজাইয়া তোলে দেবী দুর্গার আগমনি সুর। যদি জলবায়ু পরিবর্তনের ছোঁয়া বাংলার প্রকৃতিতেও লাগিয়াছে। শরতেও যেন বর্ষা ফুরাইয়াও ফুরায় না। তাহার পরও দুর্গাপূজার মাহাত্ম্য কেবল প্রকৃতির সহিত যুক্ত নহে, ইহা সনাতন বাঙালি সমাজের প্রাণস্পন্দন-তুল্য।
দেবী দুর্গা পৌরাণিক অর্থে অসুরবিনাশিনী-তিনি দমন করেন অশুভশক্তি, রক্ষা করেন শুভদীপ্তি। সনাতন শাস্ত্রকথায় আমরা দেখি, দেবতারা যখন অসুরের দম্ভে পরাজিত, তখন সকলে সম্মিলিত শক্তি দিয়া একত্র হইয়া আহ্বান করিলেন দেবীশক্তিকে। সেই মিলিত তেজরশ্মি হইতেই আবির্ভূত হইলেন মহাশক্তি দুর্গা। অর্থাৎ ঐক্যের দ্বারা উদ্ভাসিত হইয়াছে অজেয় শক্তি। এই কাহিনি কেবল পুরাণের পাতা নহে; আধুনিক জীবনেরও এক দর্পণ। সমাজে যখন বিভাজন, অহংকার, লোভ ও হিংসা বিস্তার লাভ করে, তখনই প্রয়োজন হয় শুভশক্তির সম্মিলন। তাহারাই পারে অশুভের পরাভব ঘটাইতে। সনাতন বাঙালির দুর্গোৎসব তাই কেবল দেবী আরাধনার পূজা নহে, ইহা এক মহাসম্মিলনের প্রতীক। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা মনে করেন, তাহারা কেবল মহাশক্তি হিসাবেই দেবী দুর্গার পূজা করে না; তাহাকে ‘ঘরের মেয়ে’ বলিয়া বরণও করে।
ঘরের কোলেই যিনি জন্ম নেন, যিনি মায়ের রূপে সংসার চালান, তিনিই আবার মহাশক্তি দুর্গা-এই ভাবনার ভেতর নিহিত রহিয়াছে হিন্দু সমাজের অন্তর্গত এক মর্মস্পর্শী উপলব্ধি-অসুরবিনাশী শক্তি দূর স্বর্গলোকে নহে, তাহা আমাদের নিকটেই রহিয়াছে। রহিয়াছে আমাদের সংসারের অন্দরে, নারীশক্তির মধ্যেই। এই সকল দিক ছাপাইয়া দুর্গাপূজা কেবল আধ্যাত্মিকতায় নহে, সনাতনদের মধ্যে বিপুল আনন্দেরও স্ফুরণ ঘটায়।
মণ্ডপসংলগ্ন পথভরা আলোকসজ্জা, গ্রামের উঠানে ঢাকের বাদ্য, সন্ধ্যার আরতিতে শঙ্খধ্বনি-সকল মিলাইয়া দুর্গাপূজা বাঙালির হিন্দুজীবনে বহিয়া আনে উৎসবের অপরূপ উল্লাস। এই উল্লাস কেবল আনন্দের ফল্গুধারা নহে; ইহা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দান করে অশুভবিনাশের শক্তি। যতই দুঃখ, বিপর্যয়, অনিশ্চয়তা আসুক, উৎসব মানুষকে শেখায়-জীবন অমলিন, আশার আলো কখনো নিভিয়া যায় না।
শাস্ত্র অনুযায়ী, এই বারের দুর্গোৎসবে দেবী গজে আগমন করিয়াছেনস—যাহা সমৃদ্ধি ও ফলনের বার্তা বহন করে; কিন্তু গমন ঘটিবে দোলায়, যাহা মড়ক বা বিপদের আশঙ্কা জাগায়। এই পূর্বাভাস যেন প্রতীকীরূপে আমাদের শিক্ষা দেয়-সাময়িক আনন্দ ও সমৃদ্ধির ভিতরেও লুক্কায়িত রহিয়াছে বিপদের সম্ভাবনা। তাই কেবল বাহ্যিক উজ্জ্বলতায় বিভোর না হইয়া মানুষের উচিত অন্তরের শক্তিকে সঞ্জীবিত রাখা, ঐক্যের প্রদীপ প্রজ্বলিত রাখা। ঐক্যই প্রকৃত শক্তি। সমাজে যত অশুভই আসুক, সম্মিলিত ঐক্যবদ্ধ শুভশক্তিই পারে তাহাকে প্রতিহত করিতে। দম্ভ, লোভ, হিংসা কিংবা বিভাজন-এই সকলই আধুনিক যুগের আসুরিক রূপ।