প্রকাশিত:
১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
থাইল্যান্ডে বেড়ে ওঠা পংসাকর্ন পংসাকের প্রিয় পানীয় ছিল কচি নারকেলের পানি। দেশজুড়ে রাস্তার দোকানে সহজলভ্য এ পানীয় আসে সেখানকার উর্বর মাটিতে ফলানো সবুজ কচি নারকেল থেকে। কিন্তু বিদেশে গিয়ে তিনি এ স্বাদ খুঁজে পাননি। সেই শূন্যতার বোধ থেকে তাঁর মধ্যে এক ব্যবসায়িক ধারণা তৈরি হয়। সেটা হলো থাই নারকেলের পানি বোতলজাত করে বিদেশের বাজারে পৌঁছে দেওয়া।
৪৫ বছর বয়সী পংসাকর্ন ব্যাংকক থেকে অনলাইন সাক্ষাৎকারে ফোর্বস ম্যাগাজিনকে বলেন, ‘আমাদের নারকেলের ঘ্রাণ দারুণ। তাই ভাবলাম, কেন এই ভালো জিনিসটা আমরা দুনিয়ার সামনে তুলে ধরব না?’ তাঁর প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি জেনারেল বেভারেজ ১২ বছর আগে আইএফ ব্র্যান্ডের নামে বোতলজাত নারকেলের পানি বাজারে নিয়ে আসে। বর্তমানে তাঁর কোম্পানির সহযোগী প্রতিষ্ঠান আইএফবিএইচের মাধ্যমে এই ব্র্যান্ড বিদেশে বিক্রি হচ্ছে।
চীনের মূল ভূখণ্ডে এখন আইএফ সর্বাধিক বিক্রীত নারকেলের পানির ব্র্যান্ড। সাংহাইভিত্তিক চায়না ইনসাইটস ইন্ডাস্ট্রি কনসালট্যান্সির তথ্য অনুযায়ী, বাজারে তাদের অংশীদারত্ব এক-তৃতীয়াংশের বেশি—আইএফ একাই ২৮ শতাংশ এবং তাদের আরেক পণ্য ইনোসোকো ৬ শতাংশ। প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আছে আরও অনেক ব্র্যান্ড, যেমন স্থানীয় ডেলগার্ডেন (যার বাজার হিস্যা ৫ শতাংশের কম), দেশীয় চিংশাং ড্রিংক, মার্কিন ভিটা কোকো ও থাইল্যান্ডের মালি গ্রুপের মালি কোকো।
পংসাকর্ন আত্মবিশ্বাসী, এ অবস্থান টেকসই হবে। তিনি বলেন, ‘নারকেলের পানি বললেই আইএফের নাম আসে।’ ২০২৪ সালে কোম্পানির বিক্রি বেড়ে দাঁড়ায় ১৫৮ মিলিয়ন বা ১৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার; আগের বছরের চেয়ে যা ৮০ শতাংশ বেশি। নিট মুনাফা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়ায় ৩৩ মিলিয়ন বা ৩ কোটি ৩০ লাখ ডলার। এই আয়ের ৯৭ শতাংশই আসে চীন থেকে।
চীনের বাজারে এ সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে পংসাকর্ন এবার আরও বিস্তৃত বাজারে চোখ রাখছেন। চলতি বছরের জুন মাসে হংকং শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় আইএফবিএইচ। এর মাধ্যমে ১৪৫ মিলিয়ন বা ১৪ কোটি ৫০ ডলার তোলা হয়। এই কোম্পানির শেয়ারের প্রতি আকৃষ্ট হয় বড় বিনিয়োগকারীরা—যেমন চারোয়েন পকফান্ড গ্রুপ, ইউবিএস ও চীনের হংশান ভিসি ফার্মের সহযোগী তহবিল এই কোম্পানির শেয়ার কেনে।
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার পরও পংসাকর্ন পংসাকের হিস্যা ৬০ শতাংশ। বর্তমানে তাঁর শেয়ারমূল্য দাঁড়িয়েছে ৭০০ মিলিয়ন বা ৭০ কোটি ডলার। ফলে তিনি এখন থাইল্যান্ডের অন্যতম ধনী উদ্যোক্তা। এখানেই থেমে থাকতে চান না তিনি; আইপিও থেকে পাওয়া অর্থের একটি অংশ ব্যয় করবেন চীনের বাইরের বাজার সম্প্রসারণে।
বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধির কারণে নারকেলের পানি ও উদ্ভিদভিত্তিক পানীয় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। যুক্তরাজ্যের ইউরোমনিটরের হিসাবে, ২০১৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিশ্ববাজারে এ ধরনের পানীয়র বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ শতাংশ। সফট ড্রিংকস শিল্পের গড় প্রবৃদ্ধির (৬.৬%) চেয়ে যা অনেক বেশি।
পংসাকর্নের লক্ষ্য এখন যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার বাজারে অবস্থান শক্তিশালী করা। বর্তমানে এ দুই দেশ থেকে রাজস্ব আসে অতি সামান্যই। অথচ যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে বড় নারকেলের পানির বাজার, যেখানে ২০২৪ সালে বিক্রি হয়েছে ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন বা ১৪০ কোটি ডলারের পানীয়। তবে সেখানে প্রবেশ সহজ নয়। কেননা, দীর্ঘদিন ধরে সেখানে ভিটা কোকোর অবস্থান শক্তিশালী।
পংসাকর্ন জানাচ্ছেন, তিনি এখনো থাইল্যান্ডকেই মূল সরবরাহকেন্দ্র হিসেবে ধরে রাখতে চান। এর মধ্য দিয়ে ‘থাই স্বাদকে’ বিশ্বদরবারে তুলে ধরা সম্ভব। তবে প্রয়োজনে অন্যান্য দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশ থেকেও সরবরাহ নেওয়ার পরিকল্পনা আছে।
চীনে কৌশলগত সময়োপযোগী পদক্ষেপ থেকে তারা সফলতা অর্জন করেছে। ২০১৫ সালে প্রথমে হংকংয়ে এই পণ্য বিক্রি শুরু হয়, এরপর ২০১৭ সালে চীনের মূল ভূখণ্ডে প্রবেশ করে এই পানীয়—প্রথমে আলিবাবার টিমল ও জেডি ডটকমে অনলাইন বিক্রির মাধ্যমে। পরে যোগ হয় নতুন স্বাদের ভ্যারিয়েশন—যেমন জেসমিন চালের স্বাদযুক্ত নারকেলের পানি কিংবা আম-নারকেলের দুধ। তরুণ ভোক্তাদের টার্গেট করে জনপ্রিয় তারকা শিয়াও ঝানকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর করা হয়।
কোম্পানির মডেল হলো অ্যাসেট–লাইট—অর্থাৎ উৎপাদন থেকে বিতরণ পর্যন্ত অনেক কাজ আউটসোর্সে করা হয়, যদিও কঠোরভাবে মান নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আগামী দুই বছরে তারা সরবরাহের উৎস আরও বহুমুখী করতে চায়।
পংসাকর্নের পথচলা শুরু হয়েছিল পারিবারিক ব্যবসা থেকে। যুক্তরাষ্ট্রে স্নাতক শেষে পরিবারের মালিকানাধীন সুয়ান গ্রুপে কাজ করেন। ২০১১ সালে দেশে ফিরে তিনি গড়ে তোলেন জেনারেল বেভারেজ, প্রথমে বিভিন্ন ফলের জুস দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও ২০১৫ সালে তিনি নারকেলের পানিতে পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন। তাঁর নিজের ভাষায়, ‘আমি যখন কোনো কিছুর মধ্যে ডুবে যাই, তখন কোনো পিছুটান থাকে না; পেছনে ফিরে তাকানোর অবকাশ নেই আমার।’
কোভিড মহামারিতে স্বাস্থ্যকর পানীয়র চাহিদা বেড়ে গেলে কোম্পানিটি চাহিদা মেটাতে হিমশিম খায়। তখন আন্তর্জাতিক ব্যবসাকে আলাদা করে আইএফবিএইচ গড়ে তোলা হয়। এখন রাজস্বের প্রায় ৯৮ শতাংশ আসে নারকেলের পানি থেকে। ভবিষ্যতে তিনি ফলের রস, থাই মিল্ক টি, স্বাস্থ্যকর স্ন্যাকস ও বিকল্প প্রোটিন পণ্যে বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছেন।
পংসাকর্ন বলেন, নারকেলের পানি আজ হয়তো ছোট একটি খাত, কিন্তু এর সম্ভাবনা কমলার রসের মতো। সেই সঙ্গে ব্যবসা সম্প্রসারণের চিন্তাও করছেন তিনি। নতুন পানীয় বাজারে আনার পাশাপাশি পংসাকর্ন স্বাস্থ্যকর পানীয়, উদ্ভিদভিত্তিক স্ন্যাকস ও বিকল্প প্রোটিনে বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছেন তিনি। এশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন কোম্পানি অধিগ্রহণের জন্য ২ কোটি ৬০ লাখ ডলার বরাদ্দ রেখেছেন।